Sunday 21 July 2013

২নম্বর প্লাটফর্ম দিয়ে থ্রু-ট্রেন যাবে

২নম্বর প্লাটফর্ম দিয়ে থ্রু-ট্রেন যাবে

অসীম দূরত্ব ছিল আমাদের মাঝে একদিন
তখন হয়ত তোমায় দেখেও দেখিনি কোনদিন
যেদিন প্রথম দেখে দেখলাম, আমরা দর্শনসীমার বৃত্তে এলাম
আর যেদিন দুজনকে জানলাম, পরিচিতের পরিধি পেলাম
যেদিন দুজনে সময় কাটালাম, তোমার মনে জায়গা নিলাম
যেদিন হাতটা হাতে নিলাম, তোমায় আরও কাছে পেলাম
যেদিন ঠোঁটে ঠোঁট দিলাম, সেদিন মধ্যবর্তী দূরত্ব ঘুচালাম
আর যেদিন এক হয়ে গেলাম, আসল দূরত্বটা টেরপেলাম
যে বস্তুটা এতদিন ধুমকেতুর মত ছুটত আমার পেছনে
COLLISION এর পর ছেড়ে যেতে লাগলো দূর থেকে দূরে
আর আমি হয়ে গেলাম উপগ্রহ, এই দূরত্ব বাড়া-কমার মাঝে
দূর থেকেই চারপাশে ঘুরতে থাকলাম, যেতে না পেরে কাছে
এর থেকে তো উল্কা বৃষ্টিই ভালো ছিল, এ বিরহ আর সয়না
অন্তত একবার বুকে আছড়ে পড়লে আর তো ছেড়ে যায় না
এয়োতির সুবাদে তুমি আজ আমার আত্মীয়, একই পরিবার
সকাল বিকাল উঠতে বসতে দেখাও হচ্ছে তোমার আমার
তবুও আজ আমরা দর্শনসীমার বৃত্তের বাইরে অবস্থান করছি
ইয়ার্কির সম্পর্ক আমাদের তবু সেটুকুও করতে না পারছি
খাওয়ার টেবিলে তুমি কখন হয়ত আমার পাশেই বসছ
কিন্তু আমাদের মধ্যে দূরত্ব থাকছে কয়েক আলোকবর্ষ
দরকারে কাছে আসছ গলা খাকড়িয়ে ডাকছ বউদি বলে
সে ডাক বহু দূরের ডাক, সেই ভালো যেন এরকমই চলে
কখন কাছে এসো না, আদরের সুরে কিছু বলতে যেওনা
জানত সূর্য কাছে টানলে উপগ্রহ সে ডাক ফেরাতে পারেনা

Monday 8 July 2013

সাগর



সাগর


সাগর নাকি বড় প্রিয় তোমার
কিন্তু কি দেখতে পাও তুমি তার,
সত্যি সাগরে দেখার কি আছে?
পুরো সাগর ব্যপারটাই তো মিছে।


সাগরের নীল জল টানে কি তোমায়
বাড়িতে জলে উজ্জ্বালা মেশালেই হয়
কি বলছ, সাগর বড় নিরালা নির্জন
সাগরে কত কলাহল পেতে শোন কান।


ঢেউ গুল নাকি প্রশ্ন নিয়ে আসে ছুটে
কখন শুনেছ সে প্রশ্ন, অন্তত অস্ফুটে
সাগরে সূর্যোদয় অপূর্ব লাগে তোমার
প্রতিদিন একই চিত্র, একঘেয়ে ব্যপার।


ভালোবেসে বালিতে কিছু লিখেছ যখন
ঢেউ সেটাকে থাকতে দিয়েছে কতক্ষন
সোঁদা গন্ধ কখন খারাপ লাগেনি তোমার
তাও কিসের টানে তুমি যাও বারবার।


আচ্ছা ওই নীল দিগন্ত ভালো লাগে কি
মনে হয় শুধু ওর পানে চেয়ে বসে থাকি
তুমি কখন মাঝ সমুদ্রে গিয়েছ কোনদিন
গেলে সবুজ দিগন্তর দাম বুঝবে সেদিন।



15-03-2013

Sunday 7 July 2013

বাঁধ-জলের ভালোবাসা

বাঁধ-জলের ভালোবাসা

ভীষণ রকম বাঁচার ইচ্ছে ছিল মনে
কিন্তু মরছি প্রতি রাতে প্রতি দিনে
কে তা জানিনা কিন্তু কেউ মারছে
ভিতরে ভিতরে সকল বাঁধ ভাঙছে
যে বাঁধ আমি আমার মধ্যে গড়েছি
জলের স্রোত থেকে তা দিয়ে বেঁচেছি
জলের আ-বেগ যখন যেমন বেড়েছে
বাঁধের যত্ন তখন তেমনটি হয়েছে
আজ জল শুকিয়ে গেছে অনেক দিন
তাই বাঁধেরও মেরামত হয়নি বহুদিন
জল চলে গেলে দুদিনে বাঁধ শুকিয়েছে
কত ফাটল ধরেছে , ইঁদুরে গর্ত করেছে
বাঁধের খবর আজ বহুদিন হল রাখিনি
এপথে বহুদিন আসিনি, মনেও পড়েনি
হঠাৎ আজ স্মৃতি হাতড়ে হাজির হলাম
স্বচক্ষে বাঁধের করুণ পরিস্থিতি দেখলাম
দেখলাম বাঁধের বুকের ফাটলের হাহাকার
শুনলাম ইঁদুরের গর্তের কান্নার হুহুকার
বুকে বিঁধল শুকনো জমির না মেটা পিপাসা
অনুভব করলাম বাঁধ-জলের ভালোবাসা
ওষ্ঠ অধরকে সজোরে চেপে ধরে রইল
মুখ জুড়ে ঘনকালো মেঘ ঘনিয়ে এল
মরতে শুরু করলাম আমি, মরছি এক্ষনে
এ জীবন মরার জীবন বুঝেছি এতদিনে
22-04-2013



Baba I Love You

Sunday 30 June 2013

অন্ধকারে হারাধন


 অন্ধকারে হারাধন

    অখিল বাবুর আঙিনায় বসেছে সভাটা। কেউ বলছে অতা পাগল নয় আসলে পাগল সেজে থাকে। কেউ বলছে মানুষকে ভয় দেওয়াটা ওর স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ আবার সন্দেহের সুরে বলছে এটা ওর একটা রোগ। মানসিক রোগ।
    কাল থেকে জ্বর ছাড়ছেই না মেয়েটার। ভূতের ভয়ে তো আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হওয়ার অবস্থা বেণীর। কাল সন্ধ্যায়  বেণীর মা বেণীকে সারাদিনের এঁটো বাসন গুলো ধুয়ে আনতে বলেছিল - রায়দের পুকুর থেকে। একে অমাবস্যার দিন তায় আবার সন্ধ্যা ঘুরে গিয়েছিল -- তাই একটু বেশীই ভয় পেয়েছিল মেয়েটি। থালাবাসন ফেলে চীৎকার করে ওঠে সে। তারপর একছুটে বাড়ির উঠোনে এসে পড়ে জ্ঞান হারায়। চীৎকার শুনে ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে মেয়ের এ অবস্থা দেখে হকচকিয়ে যায় বেণীর মা। এবার তার চীৎকারে এক হয় সারা পাড়া। অবশেষে মায়ের কোলে জলের ঝাপটায় জ্ঞান ফিরে এলে আবার কেঁদে ওঠে মেয়েটি। আঁচল দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে মা জানতে চায়- 'কি দেখেছিলে মা বেণী?' বন্ধচোখে বেণীর মনে ভেসে ওঠে সেই আতঙ্কের ছবি-- আজ এমনিতেই গা ছমছম করছিল তার। সন্ধ্যা ঘুরে যাওয়ায় কাছের থালা বাসনগুলকেও ঠিকমত দেখতে পাচ্ছিল না সে। এমন সময় পুকুরঘাটে ব্যাঙের ডুব দেওয়ার চেনা শব্দেও একবার চমকে ওঠে সে।  প্রায় একই সাথে একটা শব্দ আসে ঘাটের পাশের ঝোপ থেকে। সে ভাবে হয় তো রায়দের বড় বউ গোয়াল ঘরে গেছে, গরু গুলোকে খাবার দিতে। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারে রায়দের গোয়াল ঘর থেকে নয় শব্দ টা আসছে পুকুরের দক্ষিণ পাড় থেকে এবং ক্রমেই তা এগিয়ে আসছে তারই দিকে। শব্দটা যখন ২০ হাতের মধ্যে এসে পৌছয়- উঠে দাঁড়ায় বেণী। আরও কাছে আসতে থাকে শব্দটা ক্রমে, আবছা একটা মূর্তি দেখতে পায় সে-- তারপর আর কিছু বলতে পারে না। অখিলবাবু জিজ্ঞাসা করেন-- 'কি দেখেছিলে বেণী বল'। ভয়ে জড়সড় হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে সে জানায়-- একটা অচেনা জন্তু, ভয়ঙ্কর তার চেহারা, আর তার দিকেই ছুটে আসছিল জন্তুটা। কারও আর বুঝতে অসুবিধা থাকে না এই ভয়ঙ্কর জন্তুটা আসলে কে। এ ঘটনা এ পাড়ায় নতুন নয়। হারা-পাগলার ভয়ে এই সেদিনও দত্তদের পোয়াতি বৌয়ের সে-কী দুরবস্থা। এখন এ ব্যাপারে সবাই একমত কি, এরকম আর হতে দেওয়া ঠিক হবে না। মানুষকে ভয় দেওয়া তা দিন দিন স্বভাব হয়ে যাচ্ছে হারার। এখনই এর একটা বিহিত করা দরকার।
    হারা পাগলার পুরো নাম হারাধন। তার জীবনের সঙ্গে নামটা একেবারে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ পর্যন্ত জীবনের সকল পর্বের ধনই হারিয়েছে সে। -এই হারাধন কিন্তু আসলে পাগল নয়। আবার তাকে পাগল বললেও কিছু বেশী বলা হয় না। সারাদিন ঠিক থাকে- কাজ করে, খায়, ঘুময় সবই করে কিন্তু সন্ধ্যা হলেই শুরু হয় তার পাগলামি। পশ্চিম আকাশ সোনালী হতেই সোনালী দিন গুলির স্মৃতির মেঘ ভিড় করে তার মনের আকাশ জুড়ে। তারপর একটু একটু করে পরিবেশটা যতই তলিয়ে যেতে থাকে অন্ধকারের অতল গহ্বরে, স্মৃতির গহ্বর থেকে উঠে আসে তার জীবনের অন্ধকার দিক টা - প্রতিক্রিয়া শুরু হয় তার মধ্যে। সূর্য অস্ত গিয়ে অন্ধকার ঘোরাল হতেই আর ঘরে বসে থাকতে পারে না সে। রায়দের পুকুরপাড় হয়ে, গাঁয়ের মোড়ল অখিলবাবুর লম্বুবাগান পেরিয়ে, জগদীশের বাঁশ বাগান ধরে ছুটে চলে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে - আপন মনে প্রলাপ বকতে বকতে। এমন কি গভীর রাতেও তাকে একা একা ঝগড়া করতে শুনেছে অনেকে।
    হারার বয়স কত হবে- পঁচিশ কি ছাব্বিশ। আর তার এই রোগের বয়স প্রায় বছর তিনেক। কিন্তু বিজ্ঞান তো বলে মানুষের কোন রোগই একদিনে হয় না, তবে তার এই রোগের সূত্রপাত কোথায়?
    তখন তার বয়স সাত কি আট। একদিন সন্ধ্যারাতে দাওয়ায় বসে বই পড়ছিল হারা হারিকেনের আলোয়। গ্রামের মানুষ তখন রান্না খাওয়ার পাট চুকিয়ে ফেলত সন্ধ্যারাতেই। হারার মা ও রান্না করছিল। আর হারার বাবা দাওয়াতেই বসে ফাল্গুনের বাতাস উপভোগ করছলেন  মেয়েকে কোলে নিয়ে। রান্নাঘর থেকে মা হারাকে ডেকে বলেন- 'বাবা হারা, কাকিমার কাছ থেকে দুটো কাঁচা লঙ্কা নিয়ে আয় না।' হারিকেনটা নিয়ে যাবে ভেবেছিল হারা কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠলো না - সে যেই সেটা নিয়ে যেতে উদ্যত হল অন্ধকারে কেঁদে উঠলো তার বছর তিনেকের ছোট বোনটি। অগত্যা মায়ের কাছ থেকে ছোট লম্ফ জ্বালিয়ে নিয়ে চলল সে। ফাল্গুনের সন্ধ্যার বাতাসে লম্ফ নিয়ে চলা যে কত দক্ষতার কাজ তা আজকের  ছেলেমেয়েরা বুঝবে না। কাকাদের রান্নাঘরের পিছনের লেবু গাছটার কাছে যেতেই হারার লম্ফ গেল নিভে। ঈশ্বর বোধহয় ইচ্ছা করেই নিভিয়ে দিল হারার লম্ফটা। তা না হলে যে সে জানতেই পারত না আসল সত্যটা। - সে শুনতে পেল রান্নাঘরে বসে তার দুই কাকা পরামর্শ করছে তার বিধবা পিসি কে হত্যা করে সম্পত্তি করায়াত্ত করার। লম্ফ ফেলে একছুটে বাড়ি এসে বাবাকে সব বলে সে। যদিও তখন কেউ গুরুত্ব দেয়নি তার কথায় কিন্তু পরদিন সকালে আর ঘুম থেকে ওঠেনি হারার পিসি।
    হারা ছিল তার পিসির নয়নের মণি। বিয়ের তিন মাসের মধ্যেই বিধবা হয়েছিল হারার পিসি, তাই তার সকল বাৎসল্য প্রেম ছিল হারাকে জুড়েই। পিসিই শীতের দুপুরে পাড়া থেকে খুঁজে ধরে এনে গরম জলে স্নান করাত হারাকে, অতি যত্ন সহকারে কেটে দিত নখ, পরিষ্কার করে দিত কানের ময়লা। পিসিই খেজুর গাছের পাতা দিয়ে চরকি, নারকেল পাতার ঘড়ি, চশমা বানিয়ে দিত তাকে। হারার জন্য দুধের সর তুলে রাখা, নারকেল থেকে তেল বানানোর পর তার সর তুলে রাখা, ভাত খাওয়ার সময় মাছের কাঁটা বেছে দেওয়া, গ্রীষ্মের দুপুরে বাতাবী লেবু, কাঁচা আম মেখে খাওয়ানো সবই ছিল পিসির কাজ। তাই স্বাভাবিক ভাবেই এমন মর্মাহত ঘটনায় কেমন যেন হয়ে গেল হারা - মুখে একটা স্থায়ী কালো ছাপ দেখা গেল তার, হাসতে ভুলে গেল সে, জনমানসের সঙ্গ অসহ্য হয়ে উঠলো তার কাছে।
    তারপর থেকে বোনই হল হারার সারাক্ষণের সাথী। বোনকে নিয়ে সে যায় মাছ ধরতে, পাটকাঠির মাথায় জিবলি গাছের আঠা দিয়ে ফড়িং ধরে এনে দেয়, পেয়ারা চুরি করে আনে দত্তদের বাগান থেকে। বোনের সাথে কানাপুকুর থেকে আতা পেড়ে এনে কুড়োর বস্তায় পাকতে দেওয়া, রাত থাকতে ঘুম থেকে উঠে বোনকে নিয়ে আম কুড়তে যাওয়া প্রভৃতির মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে বোন কে ঘিরে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে হারা। কিন্তু নাম যে তার হারাধন - বোন কেও হারাতে হল তার। রাতের অন্ধকারে সাপে কামড়েছিল হারার বোন কে, সেই অন্ধকারেই হারা দৌড়েছিল ডাক্তার ডাকতে। কিন্তু স্থূলকায় ডাক্তার হার মানল যমদূতের বেগের কাছে। এবার হারার চেহারা গেল অর্ধেক হয়ে, খাওয়া দাওয়া প্রায় ছেড়েই দিল সে।
     দু'বছরের মধ্যে দুজন কাছের মানুষকে হারানোর দুঃখ হারাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল রায়দের মেয়ে ঝিনুক। হারার মুখের অসহায় ভাষাটা সে পরতে পেরেছিল অন্তর দিয়ে, তার কোমল হৃদয় বিদ্ধ হয়েছিল হারার অসহায়তার বাণে। অন্তরের অন্তঃস্থল হতে কি যেন একটা টান অনুভব করত সে হারার প্রতি। তাই প্রায় প্রত্যেকদিনই বিকালে ঘুরতে বের হত সে হারার সঙ্গে - পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়া সূর্যের ম্লান আলোয় তারা হাঁটত মাঠের পথ ধরে।
    বছর তিন আগের এক শীতের বিকাল, হারা আর ঝিনুক হেঁটে চলেছে মাঠের পথ ধরে।
বাড়ি থেকে ঝিনুক নারকেলনাড়ু এনেছিল হারার জন্য। উদাস মনে তাই খেতে খেতে সরষে ক্ষেতের আল বেয়ে হেঁটে চলেছে তারা। সূর্য যখন বসল পাটে ওরাও বসল ঘাসের মাঠে। ক্রমে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, বাড়ি ফেরার কথা ভুলেই গেল তারা। সন্ধ্যার অন্ধকার যত ঘনীভূত হতে থাকল ততই ঘনীভূত হতে থাকল তাদের প্রেমের আবেগ। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেল লন্ঠনের আলো আর কর্কশ গলার চীৎকারে।
    পরদিন সন্ধ্যায় বিচার বসল অখিলবাবুর আঙিনায়। বিচারে ঠিক হল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দিতে হবে ঝিনুক কে। আর বিয়ের আগে পর্যন্ত তাকে রাখতে হবে ঘরবন্দি করে। ঝিনুকের বিয়ের যাবতীয় খরচ দাবি করা হল হারার কাছে - যদিও সেই সুযোগ টা তাকে আর দেয় নি ঝিনুক। যে ঝিনুকের খোলা  দুটি ভেদ করে একটি দুর্লভ,  দুর্মূল্য নিরেট অম্লান বিন্দু ভরে দিয়েছে তার সমস্ত শূন্যতা, সেই অক্ষত বিন্দুকেই মুক্তার রূপ দিতে চায় সে। কিন্তু দূষিত জলাশয়য় মুক্তা সৃষ্টির প্রতিকূল হাওয়ায় অগত্যা আত্মহত্যার পথই বেছে নেয় সে।
    হারার মন টা যেন একটা সুপারি গাছ -- ঝড়ে নুয়ে পড়েছে বারবার কিন্তু পরক্ষণেই দাঁড়িয়েছে সোজা হয়ে। কিন্তু এবার বাজ পড়ল তাতে। সেই থেকে সে যেন 'ভাবে ভোলা বলাই' - কার সাথে তেমন একটা কথা কয় না সে, নির্বিকার হয়ে চেয়ে থাকে আকাশ পানে, কেবল সন্ধ্যা হলে একান্তে দুটো আলাপ করতে চায় অন্ধকারের সাথে। তার জীবন পরীক্ষার সকল প্রশ্নই অন্ধকারের কাছে। সে যখনই জাকে ভালোবেসেছে, কাছে টেনেছে, জড়িয়ে ধরেছে তাকেই কেড়ে নিয়েছে ভাগ্য - যার প্রত্যেকটা ঘটনার একমাত্র সাক্ষী অন্ধকার। আর রাতই তো অন্ধকারের আঁধার, গভীর রাত তো আবার অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ।
    আজকের পরিবেশটা যেন বেশ গম্ভীর। অখিলবাবুর আঙিনায় মাদুর পাতা, মাঝে একটা লন্ঠন ঘিরে বসে আছে গাঁয়ের বিজ্ঞজনেরা। বেণী কে সাথে করে তার বাবা মা বসেছে অখিল বাবুর পাশে। দুই হাতে মাথা চেপে ধরে হারা বসে আছে দুই হাঁটুর মাঝে মাথা গুঁজে ।
     যারা এই সভা আলোড়িত করে অভিযোগের ঢেউ তুলছে তারা কি কেউ পারে রাতের সাথে আলাপ করতে?
    কথা সেটা নয় -- কথা হল আজ অখিলবাবুর বাড়িতে যে সভাটা বসেছে তাও সেই সন্ধ্যার অন্ধকারে।
১২-০২-২০১৩

Tuesday 5 March 2013

আজও প্রাসঙ্গিক


আজও প্রাসঙ্গিক

                জানি না এই দিনটাতে কেন এমন উন্মাদনা ঘিরে ধরে আমায়। চরম মাত্রা পায় আবেগ, প্রাণে জাগে অবর্ণনীয় অনুভূতি, সারা বছর অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষায় থাকি দিনটার। অথচ আজকের দিনটাতেই আমি কিনা বসে আছি হাত পা গুটিয়ে! সকাল থেকেই বিরহানলে হৃদয়টা জ্বলছিল ধিকিধিকি,সারাদিনের হৃদয়-পোড়া ধোঁয়া আশ্রয় করতে থাকল সুমধুর স্মৃতিকণা গুলোকে, যা ধীরে ধীরে ঘনীভূত হয়ে বিকালের পড়ন্ত রোদে মনের আকাশে সৃষ্টি করল এক বিশাল মেঘের। সন্ধ্যার একাকীত্বের সান্নিধ্যে চোখ গলে শুরু হল বৃষ্টি। সম্বিত ফিরে পেলাম মোবাইলের চীৎকারে। ফোনের ওপার থেকে ছুটে এলো ঝড় - আমার লেখনী পেল ভাষা।
                দিন টা ছিল ১২ই জানুয়ারি ২০১৩ - স্বামী বিবেকানন্দের ১৫০তম জন্মদিন। হ্যাঁ তাকে ঘিরেই আমার যত উন্মাদনা, তাঁকে নিয়েই চোরাখুশির অবাধ প্রবেশ আমার হৃদয়ের বদ্ধ কপাটিকায়, হৃদয়াঙ্গনে তাঁরই উপস্থিতি সকালের কাঁচামিঠে রোদের পরশ বুলিয়ে যায়, তাঁর প্রসঙ্গ উঠলেই খই ফোটে আমার চাপা ঠোঁটে, আর সারা বছর ধরে প্রতীক্ষা তাঁরই জন্মদিনের। ২০০১-এর ২৪শে সেপ্টেম্বর প্রেমে পরি স্বামীজির, তারপর থেকে এই প্রথমবার কোন ১২ই জানুয়ারি  আমি বসে আছি হাত পা কোলে করে জগন্নাথ সেজে।
                সন্ধ্যার ফোনটা করেছিল এক বান্ধবী কেমন আছি তা জানার জন্য। মনের অবস্থা ব্যক্ত করতেই জ্বলে উঠলো তেলেবেগুনে- "কেন এই লোকটাকে নিয়ে এত মাতামাতি কিসের? কি করেছে সে? যদি সে দেশটাকেই উদ্ধার করে থাকবে তবে দামিনীর এই পরিণতি কেন? ভাল করে দেখলে আমাদের ঘরে ঘরে দামিনীর বাস, কদাচিৎ কেউ প্রচারে আসে কিন্তু বেশিরভাগই চেপে যায় সমাজের চর্চার খোরাক হওয়ার ভয়ে। ঘৃণা বোধকরি এই দেশে জন্মেছি বলে।"
                দেশের গণধর্ষণের ইতিহাসে সাম্প্রতিকতম সংযোগ দামিনী (http://en.wikipedia.org/wiki/2012_Delhi_gang_rape_case) ফিজিওথেরাপির ওই ছাত্রী গত ১৬ই ডিসেম্বর ২০১২ দেশের রাজধানী দিল্লীতে গণধর্ষণের শিকার হাওয়ার পর ১৩দিন মৃত্যুর সাথে অদম্য লড়াই লড়েও নিজেকে আর ফেরাতে পারেনি। ২৯সে ডিসেম্বর চলে গেল সে আমাদের দেশ, আমাদের সমাজ, আমাদের মানবিকতাকে লজ্জিত  করে। তার গলাটাই উঠে আসছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন মিছিল, শোকসভা প্রভৃতির মধ্যে দিয়ে। আমাদের ব্যাচের মেয়েগুলোই তো সেদিন কলেজে এসেছিল ধর্ষণবিরধী ট্যাগ লাগিয়ে। প্রতিক্রিয়াটা স্বাভাবিক - অভিবাদন জানাই ওদের উদ্যোগটাকে। আমি একটা ছেলে হয়ে একটা মেয়ের যন্ত্রণাটা হয়ত অত গভীর ভাবে অনুভব করতে পারিনা। কিন্তু এই ঘটনাগুলো আঘাত হানে আমারও অন্তরের নরম জায়গাটাতে। অন্তরের অন্তঃস্থল নিঃসৃত বেদনা-কাতর সহানুভূতি নিয়ে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছা করে মেয়েদের পাশে। কিন্তু আজ তো আন্তরিকতা পরিবর্তিত হয়েছে সৌজন্যে, বন্ধুত্ব পড়েছে মুখোশের মোড়ক, আর সেই যজ্ঞে ঘি হল ফেসবুক। তাই গতানুগতিক আমিও সহানুভূতিশীল বার্তাটুকু ফেসবুকে লিখেই ক্ষান্ত দেই- 'আমাদের কিছু করতে হবে'! আরে ঘণ্টা বাঁধতে হবে বললেই কাজ শেষ হয়ে গেল! কাউকে তো এগিয়ে আসতে হবে, দায়িত্ব নিতে শিখতে হবে। সেটা কে শেখাবে জাতিকে? -এখানেই প্রয়োজন স্বামী বিবেকানন্দকে। একজন অগ্রদূত হতে গেলে নিজের মধ্যে যে অসীম ক্ষমতার আধান তৈরি করতে হয় তা পাওয়া যায় স্বামীজিকে চয়ন করেই।
                'চর্মচক্ষে ভগবানের সাক্ষাৎ মেলে কিনা' এই প্রশ্নবাণে সকল স্তূতিজাল ছিন্ন করতে থাকা  দুটি সন্ধানী চোখ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের সংস্পর্শে এসে একরাশ স্নিগ্ধতায় অবগাহন করে জন্মেছেন যিনি, যিনি জীবের মধ্যে অবলোকন করেছেন শিবকে, কর্মকে যিনি পরিয়েছেন ধর্মের রাজবেশ, যিনি ত্যাগ সাধনার মূর্ত প্রতীক, সেই বীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ হলেন তারুণ্যের প্রতিমূর্তি ভারতাত্মার মূর্ত-প্রতীক। তিনিই পরাধীনতার নীরন্ধ্র অন্ধকারে নিমজ্জমান, আত্মবিস্মৃত এই জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন প্রকৃত ভারত সন্ধানে, শতধা বিচ্ছিন্ন এই জাতিকে দীক্ষিত করেছিলেন বৈদান্তিক মন্ত্রে। তাঁর অগ্নিময়ী বাণীর অধিকাংশই ছিল যুবসমাজের উদ্দেশ্যে, যার অমোঘ প্রভাবই দেশের যুবসমাজকে অনুপ্রাণিত করেছিলো জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে আপন ভাই ভাবতে। কিন্তু আজকের সমাজের দিকে তাকালে হিংসা-দ্বেষ-মারামারি যেন নিত্য জীবনের রোজনামচা। আমাদের যুবসমাজের নৈতিক চরিত্র আজ অধঃপতিত, চিন্তা ভাবের জগতে তারা দেউলিয়া, নৈরাজ্যের ক্লেদাক্ত দরজায় বসে হতাশার গগনচুম্বী পাঁচিলে মাথা কূটে মরছে তারা। যারপরনাই ঘটছে ধর্ষণের মত হীন ঘটনা। অনেকে ধর্ষণকে পাশবিক আচরণ বলে উল্লেখ করে থাকেন কিন্তু আমি তাদের সাথে একমত নই। পৃথিবীতে মানুষ ব্যতীত অপর কোন প্রাণীর অভিধানে ধর্ষণশব্দটি নেই। মনুষ্যেতর কোন প্রাণীই তার সঙ্গী কে রাজি না করিয়ে মিলিত হয় না। মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের কি পৈশাচিক রূপ!!! এই পৈশাচিক পাপের অন্ধকূপে মোহমুগ্ধ আত্মবিস্মৃত জাতির অনড় দেহে নবযুগের নবনির্মিত জিয়নকাঠির স্পর্শে অভূতপূর্ব প্রাণের স্পন্দন সঞ্চার করতে পারেন স্বামী বিবেকানন্দই। আমাদের শুধু আত্মস্থ করতে হবে তাঁর ভাবনা গুলো কে।
                এবার অন্বেষণ করা যাক ধর্ষণের প্রকৃত কারণ তার আশু সমাধান। বিষয়েই একটা আলোচনা সভা বসেছিল কলকাতা বইমেলায়।
                )অপর্ণা সেন, জাভেদ আখতার, বৃন্দা গ্রোভার, কুণাল বসু, পরমা সেন প্রমুখের উপস্থিতিতে কলকাতা মেনে নেয় ধর্ষণের উস্কানি পুরুষ মনেই। ধর্ষণকারী কোনও ভিন গ্রহের দত্যি-দানো নয়! সামগ্রিক ভাবে সমাজের সর্ব স্তরে মেয়েদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই লুকিয়ে আছে ধর্ষণের বীজ।
                আসলে আমরা ভুলে গেছি সেই কথাটাই যেটা ভুলতে বারণ করেছিলেন স্বামীজি- "হে ভারত, ভুলিও না তোমার নারীজাতির আদর্শ, সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী; ভুলিও না তোমার উপাস্য উমানাথ, সর্বত্যাগী শঙ্কর; ভুলিও না তোমার বিবাহ, তোমার ধন, তোমার জীবন ইন্দ্রিয়সুখের, নিজের ব্যক্তিগত সুখের জন্য নহে।"
                )পরমার কথায়, গোড়ায় গলদ আমাদের সমাজের মানসিকতায়। আরে, যে সমাজ প্রশ্ন করে দুবাচ্চার মা (পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ডের শিকার ) অত রাতে পার্ক স্ট্রিটে কি করছিল, সেখানে ধর্ষণের পর তো মেয়েদের ঘাড়েই দোষ চাপানো হবে"
                "India there are two great evil, trampling the women and grinding the poor through caste restriction"- দোষ টুকু দেখিয়ে দিয়েছিলেন স্বামীজি কিন্তু আমরা শুধরে নেইনি। এটা আমাদের অপারকতা।
                )জাপানিজ ওয়াইফ-এর গল্পকার কুণাল বসু মনে করেন শুধু ধর্ষণকারীরাই খলনায়ক নয়। তিনি কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন বিনোদন-শিল্প তথা চলচ্চিত্রকেও। তাঁর কথায় ম্যায় তন্দুরি চিকেন বলে আইটেম-গানের সঙ্গে যখন আমরা নাচানাচি করি, তখন কি হয়? যারা ওই গান বাঁধছেন এবং যারা চেটেপুটে উপভোগ করছেন তাঁরাও কি ধর্ষকের থেকে আলাদা কিছু?
                চলচ্চিত্র, নাচ, গান এগুলো সব সংস্কৃতির অঙ্গ। স্বামীজি তাঁর গুরুভাই ব্রহ্মানন্দকে বলেছিলেন- "The neglect of the masses is a great national sin and it is one of the causes of our downfall... Teach the masses in vernacular and give them ideas, they will get information, but something is more necessary, give them culture until you give them that."
                )ধর্ষণের বেশিরভাগটাই ঘটে অসহায় নাবালিকা বা প্রতিবন্ধী (মানসিক বা শারীরিক) মেয়েদের সাথে কিন্তু তাদের লুকোনো কান্নার স্বরটুকু অস্ফুটই থেকে যায়। দিনের আলোয় যে পাগলি মেয়েটা বাজারে বা প্ল্যাটফর্মে উচ্ছিষ্ট কুড়িয়ে খায় রাতের অন্ধকারে তার কান্না শুনতে পায় কজন!
                "Do you like to see God face to face? Serve a man in distress and see God in his smiling face."- স্বামীজিই বলেছিলেন। আর আমরা কিনা অসহায় মানুষ কে সেবার পরিবর্তে তার অসহায়তার সুযোগ নিচ্ছি।
                )পাশ্চাত্যের অনেক জায়গায় ফ্রি সেক্স চালু আছে কিন্তু সেটা আমাদের দেশে নেই কেন - মজার ছলে এই আক্ষেপটা আমরা অনেকেই করে থাকি। তাদের শুক্রবারের রাত সম্পর্কে কত কাঙ্খিত ভাবনাই না ভাবি। এই মানসিকতা টা কি কখন আমাদের ধর্ষণে অনুপ্রাণিত করে না!
                “অপরের ভাল জিনিস অবশ্যই নিবে কিন্তু অন্ধ অনুকরণ নয়, যুক্তি দিয়ে অনুসরণ কর অপর কে। যারা তাদের নিজের নিজের খারাপ বিষয় গুলো আমার দেশবাসীর মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে আমি তাদের সাথে একমত নই। আমি চাই প্রাচীন ভারতের সদগুণ গুলো পুনরায় জেগে উঠুক আর তার সাথে যুক্ত হক বর্তমান ভারতের যাকিছু শক্তিশালী গুণ। শুধু এই মিশ্র ব্যাপারটা স্বাভাবিক হওয়া চাই। নতুন ভারত কে গড়ে উঠতে হবে সম্পূর্ণ ভেতর থেকে।স্বামীজির এই আদেশ অমান্য করে আমরা অপরের খারাপটাকেই করছি অন্ধ অনুকরণ।
                আমাদের মেয়েদের অভব্য পোশাক ধর্ষণের জন্য অনেকাংশে দায়ী। পোশাকের এই ধরনটাও সেই অনুকরণ।
                )পর্নো নিষিদ্ধ প্রায় সব সভ্য দেশে। কিন্তু পর্নোর চাহিদা সব দেশেই প্রচণ্ড। সব পর্নো-ছবি দেখে ধর্ষণ করার শখ হয় পুরুষের।
                “সংযম অবলম্বন করতে শেখ, ষড়েন্দ্রিয়ের সংযম।... খারাপ জিনিস দেখা শোনা থেকে নিজেকে বিরত রাখো।কথাটা বলেছিলেন বটে স্বামীজি কিন্তু তার থেকে বড় পরিবর্তন দরকার পর্নো ব্যবসায়ীদের মানসিকতার। এমন একটা ব্যবসা তারা করছে যা বিষিয়ে দিচ্ছে আট থেকে আশি সবার মানসিকতা। মা-বাবারও একটা দায়িত্ব থাকে ছেলেমেয়েদের সঠিক পথে চালিত করা, তাদের সুস্থ মানসিকতা তৈরি করা; সেটাও দেখতে হবে। নিজেদের জীবনের ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে সেই দায়িত্বটাকে সূক্ষ্ম ভাবে এড়িয়ে গেলে ফল কিন্তু খুব খারাপ হবে।
                )তসলিমা নাসরিনের মতে "ধর্ষণ আর যা কিছুই হোক, যৌনসঙ্গম নয়। ধর্ষণ কেউ যৌনক্ষুধা মেটানোর জন্য করে না। প্রায় সব ধর্ষকেরই স্থায়ী যৌনসঙ্গী আছে। ধর্ষণ নিতান্তই পেশির জোর, পুরুষের জোর, আর পুরুষাঙ্গের জোর। মোদ্দা কথা, পিতৃতান্ত্রিক সমাজের পরম পূজনীয় পুরুষাঙ্গের ন্যাড়া মাথায় মুকুট পরানো বা বিজয় নিশান ওড়ানোর আর এক নাম ধর্ষণ। "
                সমাধান টাও তিনিই খুঁজেছেন "ধর্ষকদের জীবনকাহিনী ঘাঁটলে দেখা যায় বেশির ভাগেরই বিচ্ছিরি একটা শৈশব ছিল, ভাল শিক্ষাদীক্ষা বলতে কিছুই ছিল না, মারামারি দেখতে দেখতে, ঘৃণা দেখতে দেখতে, পৌরুষিক পাষণ্ডতা দেখতে দেখতে বড় হয়েছে। এগুলোই শিখেছে। শেখা সহজ, না-শেখা সহজ নয়। শিখে ফেলা তন্ত্র-মন্ত্র-পুরুষতন্ত্র আর নারীবিরোধী-কুসংস্কারগুলো যে করেই হোক না শেখা বা আনলার্ন-এর ট্র্যাশক্যানে ফেলতে হবে। স্কুলের শুরু থেকেই নারীপুরুষের সমানাধিকারের শিক্ষা সব শিশুকে দাও, দিতে থাকো। শিশুরা ভাল শিক্ষা আর ভাল পরিবেশ পেলে মানুষ ভাল হয়।" স্বামীজির গলায়ও সেই একই সুর "Education is the manifestation of perfection already in man... শিক্ষা সকলের দ্বারাই সম্ভব, জাতিকে শিক্ষিত করতে হবে, নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলকে দিতে হবে সেই শিক্ষা যাতে চরিত্র গঠন হয়, মনের শক্তি বাড়ে, বুদ্ধির বিকাশ ঘটে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে।"
                আসলে আমরা বিবেকানন্দকে পড়ি কিন্তু আত্মস্থ করি না, বিবেকানন্দের স্থান আমাদের স্মৃতির কোটরে কিন্তু মননে নয়। তার বাণীগুলো আওড়াই কিন্তু জীবনে প্রয়োগ করিনা। আর সেটুকু করতেই পারলেই আমরা হব কলুষমুক্ত। স্বামীজির স্বপ্ন ছিল- "যদি এমন একটি রাষ্ট্র গঠন করা যায়, যাতে ব্রাহ্মণ্য যুগের জ্ঞান, ক্ষত্রিয়ের সভ্যতা, বৈশ্যের সম্প্রসারণ শক্তি এবং শূদ্রের সাম্যের আদর্শ মিলিত হয়েছে।" আমার বান্ধবীটির মতে স্বামীজির সেই স্বপ্নের দেশে কিনা আজ  'ঘরে ঘরে দামিনীর বাস' ভাল করে ভেবে দেখলে ওর কথাটা একদমই অমূলক নয়। দেশে এমন মেয়ে খুব কমই আছে যারা কখনই ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানি বা ছেলেদের অভব্য আচরণের শিকার হয় নি, অন্তত নগ্ন চোখের পোশাক ভেদকরা নোংরা চাউনির চাটনি তো হতেই হয়েছে সবাইকে। আমরা  স্বামীজির সেই স্বপ্নের দেশের অধিবাসী হয়েও খবরের কাগজে ধর্ষণের খবর দেখে ব্যথিত হওয়ার পরিবর্তে পুলকিত হই। স্বামীজির সেই স্বপ্নের দেশেই শিক্ষায় প্রথমস্থানাধিকারী রাজ্য কেরলে  বছরের মেয়ে স্কুল  থেকে বাড়ি ফিরতে চাইছে না। কাঁদছে। কেন কাঁদছে? বাড়িতে দুবছর হল প্রতি দিন তাকে ধর্ষণ করছে তার বাবা, দাদা আর দুই কাকা। স্বামীজির সেই স্বপ্নের দেশে শাসক গোষ্ঠীর পোষ্য একপাল দস্যু কে যে-নারী ধর্ষণ করতে বাধা দিচ্ছে তার যৌনাঙ্গে লাঠির মাথা সোজা ভরে দেওয়া হচ্ছে; শুধু তাই নয় যন্ত্রণায় সে যখন দয়া চায়, গালাগালি করে তার সামনে তার কোলের শিশুটিকে দুপা ধরে দুই দিকে টেনে সোজাসুজি ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। স্বামীজির সেই স্বপ্নের দেশেই ধর্ষণের পর ধর্ষিতার অভিযোগ লিখতে ঢিলেমি করে পুলিশ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলে সাজানো ঘটনা, রাজনৈতিক নেত্রী ধর্ষিতাকে যৌনকর্মী বলে উল্লেখ করে বলেন, “ওটা ধর্ষণের ঘটনাই নয়। ওই মহিলা আর তাঁর খদ্দেরদের মধ্যে গোলমাল।আচ্ছা যৌনকর্মীকেও কি ধর্ষণ করা যায়? যৌনকর্মী ধর্ষিতা হলে কি তাঁর বিচার চাওয়ার অধিকার নেই!? স্বামীজির সেই স্বপ্নের দেশেই ধর্ষণের পর রাজনৈতিক নেতার মন্তব্য "অত রাতে ওই মহিলা ওখানে কি করছিল? সে তো ধর্ষিতা হতেই গিয়েছিল ওখানে।" ওহ দেশবন্ধু, দেশের সেবক, রাজনীতিবিদ একবার বলবেন কি ঠিক রাত কটার পর কোন মহিলা ঘর থেকে বের হলে তাকে ধর্ষণ করার অধিকার পাওয়া যায় বা তাকে ধর্ষণ করা টা স্বাভাবিক ঘটনার মধ্যে পরে?! স্বামীজির সেই স্বপ্নের দেশের রাজধানী দিল্লীতে এক মেয়েকে এক পাল পুরুষ বীভৎস ভাবে ধর্ষণ করেছে; শুধু গণধর্ষণ নয়, আরও ভয়ংকর কিছু, পুরুষাঙ্গ দিয়েই আঘাত করে শান্ত হয়নি তারা, লোহার রড যৌনাঙ্গে ঢুকিয়ে জরায়ু ফুটো করে পেটের নাড়ি ভুঁড়ি বের করে নিয়ে এসেছে। যৌনাঙ্গে যখন পেটের নাড়ি, তখনও তাদের ধর্ষণ বন্ধ হয়নি। ধর্ষণুল্লাশ শেষ হলে প্রায়-মৃত মেয়েকে চলন্ত বাস থেকে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে। সেই মেয়েটি মারা যাওয়ার পর দেশের ৭০% লোক বলে, পুরুষাঙ্গ কেটে ফ্যালো ২২% লোক বলে, মৃত্যুদণ্ড দাও % লোক ইনিয়েবিনিয়ে নানা কথা বলে, what about teh menz?, পুরুষদেরও তো মেয়েরা ধর্ষণ করে, তার বেলা?, মেয়েটা নিশ্চয়ই পুরুষদের প্রোভোক করার জন্য গায়ে কিছু পরেছিল, বা কিছু মেখেছিল।
                আপসহীন লেখক তসলিমা নাসরিন তার বাংলা ব্লগে ২০১২- ২৯ শে ডিসেম্বর  একটা প্রবন্ধ লেখেন নাবালিকা ধর্ষণএই শিরনামে (http://muktobhabna.blogspot.in/2012/12/blog-post_870.html) আর সেই লেখাটাই পরদিনের  আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়-তে ছাপা হয় ল্যাজে পাএই শিরনামে (http://www.anandabazar.com/archive/1121230/30rabipro3.html) সেখানে তিনি বলেন "আমাদের কাছে আসলে ধর্ষণের সমাধান দুটো, হয় মৃত্যুদণ্ড, নয় পুরুষাঙ্গ-কর্তন। দুটো শাস্তি ধর্ষকদের দিলেই নাকি ধর্ষণের ইতি ঘটে। ইতি তো ঘটেইনি, বরং আকাশ ছুঁয়েছে। ধনঞ্জয়ের ফাঁসি হওয়ার পর পর ধর্ষণ বেড়ে গিয়েছিল, মনে নেই? দেশকে ধর্ষণমুক্ত করতে গেলে সরকারকে প্রচুর কাজ করতে হয়। প্রচুর পরিশ্রম। তার চেয়ে ধর্ষককে ফাঁসি দেওয়ার মতো সহজ কাজ আর কিছু নেই। জনগণও খুশি হয়। তখনকার মতো সব সমস্যাকে চমৎকার ধামাচাপা দেওয়া যায়। সরকার ভাবেই মানুষকে বোকা বানায়। মানুষ বুদ্ধিমান হয়ে গেলে বেজায় মুশকিল! তখন যে কাজগুলো করলে সমাজের সত্যিকার ভাল হয়, সে কাজগুলোর দাবি সরকারের কাছে করে বসবে বুদ্ধিমান মানুষেরা।" কবি জয় গোস্বামীও যে মৃত্যুদণ্ডে ধর্ষণের সমাধান দেখছেন না তার এক স্বচ্ছ চিত্র ফুটে উঠেছে তার 'কে বেশি কে কম' কবিতায় (http://banglalibrary.evergreenbangla.com/joygoswami/12) জাভেদ-বৃন্দাদেরও যুক্তি, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডকে অনিবার্য মনে নিলে পুরুষতন্ত্রের চিরকেলে ধারণাটিকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যে দেশে বেশির ভাগ ধর্ষণই চেনা-জানার বৃত্তে, জনকে ফাঁসিতে চড়ানো হবে?

                 তাহলে ধর্ষণ বন্ধ হবে কবে, অথবা কি করলে ধর্ষণ বন্ধ হবে? এই প্রশ্নটির সবচেয়ে ভাল উত্তর, আমরা যেদিন ধর্ষণ করা বন্ধ করব সেদিনই বন্ধ হবে ধর্ষণ; যদি আমরা আজ বন্ধ করি তবে আজ, যদি কাল করি তবে কাল, যদি এক মাস পরে করি তবে এক মাস পর আর যদি আমরা ধর্ষণ করা বন্ধ না করি তাহলে কোন দেশ, কোন রাষ্ট্র, কোন আইন, কোন শাস্তি, পুরুষাঙ্গ কর্তন বা মৃত্যুদণ্ড কোন কিছুই পারবে না বন্ধ করতে। তখন মৃত্যুর পর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলতে থাকবে এই পৈশাচিক পাপ। তাই যেদিন আমরা আত্মস্থ করতে পারব এই কথা গুলকে "হে বীর, সাহস অবলম্বন কর; সদর্পে বল আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই; বল মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই; তুমিও কটিমাত্র-বস্ত্রাবৃত হইয়া সদর্পে ডাকিয়া বল ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারাণসী; বল ভাই ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ; আর বল দিনরাত, হে গৌরীনাথ, হে জগদম্বে, আমায় মনুষ্যত্ব দাও; মা, আমার দুর্বলতা কাপুরুষতা দূর কর, আমায় মানুষ কর।" সেদিন আমরা হব মনুষ্যত্ব সম্পন্ন মানুষ, আর যেদিন আমরা মানুষ হব, সেদিন আমাদের বিবেক বাধা দেবে ধর্ষণ করতে, সে দিনই বন্ধ হবে ধর্ষণ, গড়ে উঠবে নতুন ভারত, স্বামীজির স্বপ্নের ভারত।
                চারিদিকে এখন অসুর শক্তির জয়জয়াকার, আত্মভ্রষ্ট যুবসমাজ পৈশাচিক আনন্দে বিভোর, লক্ষ্যশূণ্য অগণন যুবক সঙ্কটের আবর্তে বিপন্ন, বিমূঢ়, বিভ্রান্ত। এইসব যুবকের কাছে জীবন, আদর্শ, মানবসেবা মনে হয় অর্থহীন, অপ্রয়োজন। অদ্ভুত আঁধার চলিষ্ণু জাতির কাছে কখনই কাম্য হতে পারে না। কারণ যেকোনো জাতির কাছে তার যুবসমাজ হল তার সম্পদ। আজকের যুবসমাজের সম্যক ধারনা নেই  দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কেনিজেদের অতীত ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি সম্পর্কে।  যেটা স্বামীজি সম্পূর্ণরূপে অর্জন করেছিলেন আসমুদ্রহিমাচল পদব্রজে ভ্রমণের সময়। যে কারণেই তিনি ভগ্নী নিবেদিতাকে বলতে পেরেছিলেন "আমিই ভারতবর্ষ" তাই স্বামী বিবেকানান্দাকে জানলেই ভারতবর্ষ কে জানা হয়, জানা হয় দেশের  কৃষ্টি, সংস্কৃতি ঐতিহ্য কে। বর্তমানে আমরা যে দুঃসহ জটিল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে চলেছি তাতে অকপট যাপন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে, সত্য অবলম্বনও খুব কঠিন হয়ে পড়েছে, ত্যাগব্রত নেহাতই কথার কথায় রূপান্তরিত হয়েছে। তাই সমাজের এই দুর্বিষহ অচল অবস্থা থেকে রেহাই পেতে গেলে আমাদের শপথ নিতে হবে তার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার যে মানুষটি তার সারাটা জীবন দিয়ে নতুন ভারত গড়ার স্বপ্ন দেখে গেলেন আর তা বাস্তবায়িত করার পথ বাতলে গেলেন। উপলব্ধি করতে শিখতে হবে আমাদের দায়িত্ব কর্তব্যকে, সুস্থ ব্যবহার করতে শিখতে হবে আমাদের ভিতরের প্রজ্ঞা, শক্তি তেজ কে আর আত্মস্থ করতে শিখতে হবে স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শকে।
৩০-০১-২০১৩