আজও প্রাসঙ্গিক
জানি না এই দিনটাতে কেন এমন উন্মাদনা ঘিরে ধরে আমায়। চরম মাত্রা পায় আবেগ, প্রাণে জাগে অবর্ণনীয় অনুভূতি, সারা বছর অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষায় থাকি দিনটার। অথচ আজকের দিনটাতেই আমি কিনা বসে আছি হাত পা গুটিয়ে! সকাল থেকেই বিরহানলে হৃদয়টা জ্বলছিল ধিকিধিকি,সারাদিনের হৃদয়-পোড়া ধোঁয়া আশ্রয় করতে থাকল সুমধুর স্মৃতিকণা গুলোকে, যা ধীরে ধীরে ঘনীভূত হয়ে বিকালের পড়ন্ত রোদে মনের আকাশে সৃষ্টি করল এক বিশাল মেঘের। সন্ধ্যার একাকীত্বের সান্নিধ্যে চোখ গলে শুরু হল বৃষ্টি। সম্বিত ফিরে পেলাম মোবাইলের চীৎকারে। ফোনের ওপার থেকে ছুটে এলো ঝড় - আমার লেখনী পেল ভাষা।
দিন টা ছিল ১২ই জানুয়ারি ২০১৩ - স্বামী বিবেকানন্দের ১৫০তম জন্মদিন। হ্যাঁ তাকে ঘিরেই আমার যত উন্মাদনা, তাঁকে নিয়েই চোরাখুশির অবাধ প্রবেশ আমার হৃদয়ের বদ্ধ কপাটিকায়, হৃদয়াঙ্গনে তাঁরই উপস্থিতি সকালের কাঁচামিঠে রোদের পরশ বুলিয়ে যায়, তাঁর প্রসঙ্গ উঠলেই খই ফোটে আমার চাপা ঠোঁটে, আর সারা বছর ধরে প্রতীক্ষা তাঁরই জন্মদিনের। ২০০১-এর ২৪শে সেপ্টেম্বর প্রেমে পরি স্বামীজির, তারপর থেকে এই প্রথমবার কোন ১২ই জানুয়ারি আমি বসে আছি হাত পা কোলে করে জগন্নাথ সেজে।
সন্ধ্যার ফোনটা করেছিল এক বান্ধবী কেমন আছি তা জানার জন্য। মনের অবস্থা ব্যক্ত করতেই জ্বলে উঠলো তেলেবেগুনে- "কেন এই লোকটাকে নিয়ে এত মাতামাতি কিসের? কি করেছে সে? যদি সে দেশটাকেই উদ্ধার করে থাকবে তবে দামিনীর এই পরিণতি কেন? ভাল করে দেখলে আমাদের ঘরে ঘরে দামিনীর বাস, কদাচিৎ কেউ প্রচারে আসে কিন্তু বেশিরভাগই চেপে যায় সমাজের চর্চার খোরাক হওয়ার ভয়ে। ঘৃণা বোধকরি এই দেশে জন্মেছি বলে।"
দেশের গণধর্ষণের ইতিহাসে সাম্প্রতিকতম সংযোগ দামিনী (http://en.wikipedia.org/wiki/2012_Delhi_gang_rape_case)। ফিজিওথেরাপির ওই ছাত্রী গত ১৬ই ডিসেম্বর ২০১২ দেশের রাজধানী দিল্লীতে গণধর্ষণের শিকার হাওয়ার পর ১৩দিন মৃত্যুর সাথে অদম্য লড়াই লড়েও নিজেকে আর ফেরাতে পারেনি। ২৯সে ডিসেম্বর চলে গেল সে আমাদের দেশ, আমাদের সমাজ, আমাদের মানবিকতাকে লজ্জিত
করে। তার গলাটাই উঠে আসছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন মিছিল, শোকসভা প্রভৃতির মধ্যে দিয়ে। আমাদের ব্যাচের মেয়েগুলোই তো সেদিন কলেজে এসেছিল ধর্ষণবিরধী ট্যাগ লাগিয়ে। প্রতিক্রিয়াটা স্বাভাবিক - অভিবাদন জানাই ওদের উদ্যোগটাকে। আমি একটা ছেলে হয়ে একটা মেয়ের যন্ত্রণাটা হয়ত অত গভীর ভাবে অনুভব করতে পারিনা। কিন্তু এই ঘটনাগুলো আঘাত হানে আমারও অন্তরের নরম জায়গাটাতে। অন্তরের অন্তঃস্থল নিঃসৃত বেদনা-কাতর সহানুভূতি নিয়ে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছা করে মেয়েদের পাশে। কিন্তু আজ তো আন্তরিকতা পরিবর্তিত হয়েছে সৌজন্যে, বন্ধুত্ব পড়েছে মুখোশের মোড়ক, আর সেই যজ্ঞে ঘি হল ফেসবুক। তাই গতানুগতিক আমিও সহানুভূতিশীল বার্তাটুকু ফেসবুকে লিখেই ক্ষান্ত দেই- 'আমাদের কিছু করতে হবে'! আরে ঘণ্টা বাঁধতে হবে বললেই কাজ শেষ হয়ে গেল! কাউকে তো এগিয়ে আসতে হবে, দায়িত্ব নিতে শিখতে হবে। সেটা কে শেখাবে জাতিকে? -এখানেই প্রয়োজন স্বামী বিবেকানন্দকে। একজন অগ্রদূত হতে গেলে নিজের মধ্যে যে অসীম ক্ষমতার আধান তৈরি করতে হয় তা পাওয়া যায় স্বামীজিকে চয়ন করেই।
'চর্মচক্ষে ভগবানের সাক্ষাৎ মেলে কিনা' এই প্রশ্নবাণে সকল স্তূতিজাল ছিন্ন করতে থাকা দুটি সন্ধানী চোখ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের সংস্পর্শে এসে একরাশ স্নিগ্ধতায় অবগাহন করে জন্মেছেন যিনি, যিনি জীবের মধ্যে অবলোকন করেছেন শিবকে, কর্মকে যিনি পরিয়েছেন ধর্মের রাজবেশ, যিনি ত্যাগ ও সাধনার মূর্ত প্রতীক, সেই বীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ হলেন তারুণ্যের প্রতিমূর্তি ও ভারতাত্মার মূর্ত-প্রতীক। তিনিই পরাধীনতার নীরন্ধ্র অন্ধকারে নিমজ্জমান, আত্মবিস্মৃত এই জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন প্রকৃত ভারত সন্ধানে, শতধা বিচ্ছিন্ন এই জাতিকে দীক্ষিত করেছিলেন বৈদান্তিক মন্ত্রে। তাঁর অগ্নিময়ী বাণীর অধিকাংশই ছিল যুবসমাজের উদ্দেশ্যে, যার অমোঘ প্রভাবই দেশের যুবসমাজকে অনুপ্রাণিত করেছিলো জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে আপন ভাই ভাবতে। কিন্তু আজকের সমাজের দিকে তাকালে হিংসা-দ্বেষ-মারামারি যেন নিত্য জীবনের রোজনামচা। আমাদের যুবসমাজের নৈতিক চরিত্র আজ অধঃপতিত, চিন্তা ও ভাবের জগতে তারা দেউলিয়া, নৈরাজ্যের ক্লেদাক্ত দরজায় বসে হতাশার গগনচুম্বী পাঁচিলে মাথা কূটে মরছে তারা। যারপরনাই ঘটছে ধর্ষণের মত হীন ঘটনা। অনেকে ধর্ষণকে পাশবিক আচরণ বলে উল্লেখ করে থাকেন কিন্তু আমি তাদের সাথে একমত নই। পৃথিবীতে মানুষ ব্যতীত অপর কোন প্রাণীর অভিধানে ‘ধর্ষণ’ শব্দটি নেই। মনুষ্যেতর কোন প্রাণীই তার সঙ্গী কে রাজি না করিয়ে মিলিত হয় না। মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের এ কি পৈশাচিক রূপ!!! এই পৈশাচিক পাপের অন্ধকূপে মোহমুগ্ধ আত্মবিস্মৃত জাতির অনড় দেহে নবযুগের নবনির্মিত জিয়নকাঠির স্পর্শে অভূতপূর্ব প্রাণের স্পন্দন সঞ্চার করতে পারেন স্বামী বিবেকানন্দই। আমাদের শুধু আত্মস্থ করতে হবে তাঁর ভাবনা গুলো কে।
এবার অন্বেষণ করা যাক ধর্ষণের প্রকৃত কারণ ও তার আশু সমাধান। এ বিষয়েই একটা আলোচনা সভা বসেছিল কলকাতা বইমেলায়।
১)অপর্ণা সেন, জাভেদ আখতার, বৃন্দা গ্রোভার, কুণাল বসু, পরমা সেন প্রমুখের উপস্থিতিতে কলকাতা মেনে নেয় ধর্ষণের উস্কানি পুরুষ মনেই। ধর্ষণকারী কোনও ভিন গ্রহের দত্যি-দানো নয়! সামগ্রিক ভাবে সমাজের সর্ব স্তরে মেয়েদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই লুকিয়ে আছে ধর্ষণের বীজ।
আসলে আমরা ভুলে গেছি সেই কথাটাই যেটা ভুলতে বারণ করেছিলেন স্বামীজি- "হে ভারত, ভুলিও না তোমার নারীজাতির আদর্শ, সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী; ভুলিও না তোমার উপাস্য উমানাথ, সর্বত্যাগী শঙ্কর; ভুলিও না তোমার বিবাহ, তোমার ধন, তোমার জীবন ইন্দ্রিয়সুখের, নিজের ব্যক্তিগত সুখের জন্য নহে।"
২)পরমার কথায়, গোড়ায় গলদ আমাদের সমাজের মানসিকতায়। আরে, যে সমাজ প্রশ্ন করে দুবাচ্চার মা (পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ডের শিকার ) অত রাতে পার্ক স্ট্রিটে কি করছিল, সেখানে ধর্ষণের পর তো মেয়েদের ঘাড়েই দোষ চাপানো হবে"।
"India
there are two great evil, trampling the women and grinding the poor through
caste restriction"- দোষ টুকু দেখিয়ে দিয়েছিলেন স্বামীজি কিন্তু আমরা শুধরে নেইনি। এটা আমাদের অপারকতা।
৩)জাপানিজ ওয়াইফ-এর গল্পকার কুণাল বসু মনে করেন শুধু ধর্ষণকারীরাই খলনায়ক নয়। তিনি কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন বিনোদন-শিল্প তথা চলচ্চিত্রকেও। তাঁর কথায় ম্যায় তন্দুরি চিকেন বলে আইটেম-গানের সঙ্গে যখন আমরা নাচানাচি করি, তখন কি হয়? যারা ওই গান বাঁধছেন এবং যারা চেটেপুটে উপভোগ করছেন তাঁরাও কি ধর্ষকের থেকে আলাদা কিছু?
চলচ্চিত্র, নাচ, গান এগুলো সব সংস্কৃতির অঙ্গ। স্বামীজি তাঁর গুরুভাই ব্রহ্মানন্দকে বলেছিলেন- "The neglect
of the masses is a great national sin and it is one of the causes of our
downfall... Teach the masses in vernacular and give them ideas, they will get
information, but something is more necessary, give them culture until you give
them that."
৪)ধর্ষণের বেশিরভাগটাই ঘটে অসহায় নাবালিকা বা প্রতিবন্ধী (মানসিক বা শারীরিক) মেয়েদের সাথে কিন্তু তাদের লুকোনো কান্নার স্বরটুকু অস্ফুটই থেকে যায়। দিনের আলোয় যে পাগলি মেয়েটা বাজারে বা প্ল্যাটফর্মে উচ্ছিষ্ট কুড়িয়ে খায় রাতের অন্ধকারে তার কান্না শুনতে পায় কজন!
"Do
you like to see God face to face? Serve a man in distress and see God in his
smiling face."- স্বামীজিই বলেছিলেন। আর আমরা কিনা অসহায় মানুষ কে সেবার পরিবর্তে তার অসহায়তার সুযোগ নিচ্ছি।
৫)পাশ্চাত্যের অনেক জায়গায় ফ্রি সেক্স চালু আছে কিন্তু সেটা আমাদের দেশে নেই কেন - মজার ছলে এই আক্ষেপটা আমরা অনেকেই করে থাকি। তাদের শুক্রবারের রাত সম্পর্কে কত কাঙ্খিত ভাবনাই না ভাবি। এই মানসিকতা টা কি কখন আমাদের ধর্ষণে অনুপ্রাণিত করে না!
“অপরের ভাল জিনিস অবশ্যই নিবে কিন্তু অন্ধ অনুকরণ নয়, যুক্তি দিয়ে অনুসরণ কর অপর কে। যারা তাদের নিজের নিজের খারাপ বিষয় গুলো আমার দেশবাসীর মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে আমি তাদের সাথে একমত নই। আমি চাই প্রাচীন ভারতের সদগুণ গুলো পুনরায় জেগে উঠুক আর তার সাথে যুক্ত হক বর্তমান ভারতের যাকিছু শক্তিশালী গুণ। শুধু এই মিশ্র ব্যাপারটা স্বাভাবিক হওয়া চাই। নতুন ভারত কে গড়ে উঠতে হবে সম্পূর্ণ ভেতর থেকে।” স্বামীজির এই আদেশ অমান্য করে আমরা অপরের খারাপটাকেই করছি অন্ধ অনুকরণ।
আমাদের মেয়েদের অভব্য পোশাক ও ধর্ষণের জন্য অনেকাংশে দায়ী। পোশাকের এই ধরনটাও সেই অনুকরণ।
৬)পর্নো নিষিদ্ধ প্রায় সব সভ্য দেশে। কিন্তু পর্নোর চাহিদা সব দেশেই প্রচণ্ড। এ সব পর্নো-ছবি দেখে ধর্ষণ করার শখ হয় পুরুষের।
“সংযম অবলম্বন করতে শেখ, ষড়েন্দ্রিয়ের সংযম।... খারাপ জিনিস দেখা ও শোনা থেকে নিজেকে বিরত রাখো।” কথাটা বলেছিলেন বটে স্বামীজি কিন্তু তার থেকে বড় পরিবর্তন দরকার পর্নো ব্যবসায়ীদের মানসিকতার। এমন একটা ব্যবসা তারা করছে যা বিষিয়ে দিচ্ছে আট থেকে আশি সবার মানসিকতা। মা-বাবারও একটা দায়িত্ব থাকে ছেলেমেয়েদের সঠিক পথে চালিত করা, তাদের সুস্থ মানসিকতা তৈরি করা; সেটাও দেখতে হবে। নিজেদের জীবনের ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে সেই দায়িত্বটাকে সূক্ষ্ম ভাবে এড়িয়ে গেলে ফল কিন্তু খুব খারাপ হবে।
৭)তসলিমা নাসরিনের মতে "ধর্ষণ আর যা কিছুই হোক, যৌনসঙ্গম নয়। ধর্ষণ কেউ যৌনক্ষুধা মেটানোর জন্য করে না। প্রায় সব ধর্ষকেরই স্থায়ী যৌনসঙ্গী আছে। ধর্ষণ নিতান্তই পেশির জোর, পুরুষের জোর, আর পুরুষাঙ্গের জোর। মোদ্দা কথা, পিতৃতান্ত্রিক সমাজের পরম পূজনীয় পুরুষাঙ্গের ন্যাড়া মাথায় মুকুট পরানো বা বিজয় নিশান ওড়ানোর আর এক নাম ধর্ষণ। "
সমাধান টাও তিনিই খুঁজেছেন "ধর্ষকদের জীবনকাহিনী ঘাঁটলে দেখা যায় বেশির ভাগেরই বিচ্ছিরি একটা শৈশব ছিল, ভাল শিক্ষাদীক্ষা বলতে কিছুই ছিল না, মারামারি দেখতে দেখতে, ঘৃণা দেখতে দেখতে, পৌরুষিক পাষণ্ডতা দেখতে দেখতে বড় হয়েছে। এগুলোই শিখেছে। শেখা সহজ, না-শেখা সহজ নয়। শিখে ফেলা তন্ত্র-মন্ত্র-পুরুষতন্ত্র আর নারীবিরোধী-কুসংস্কারগুলো যে করেই হোক না শেখা বা আনলার্ন-এর ট্র্যাশক্যানে ফেলতে হবে। স্কুলের শুরু থেকেই নারীপুরুষের সমানাধিকারের শিক্ষা সব শিশুকে দাও, দিতে থাকো। শিশুরা ভাল শিক্ষা আর ভাল পরিবেশ পেলে মানুষ ভাল হয়।" স্বামীজির গলায়ও সেই একই সুর "Education is the manifestation of perfection
already in man... শিক্ষা সকলের দ্বারাই সম্ভব, জাতিকে শিক্ষিত করতে হবে, নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলকে দিতে হবে সেই শিক্ষা যাতে চরিত্র গঠন হয়, মনের শক্তি বাড়ে, বুদ্ধির বিকাশ ঘটে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে।"
আসলে আমরা বিবেকানন্দকে পড়ি কিন্তু আত্মস্থ করি না, বিবেকানন্দের স্থান আমাদের স্মৃতির কোটরে কিন্তু মননে নয়। তার বাণীগুলো আওড়াই কিন্তু জীবনে প্রয়োগ করিনা। আর সেটুকু করতেই পারলেই আমরা হব কলুষমুক্ত। স্বামীজির স্বপ্ন ছিল- "যদি এমন একটি রাষ্ট্র গঠন করা যায়, যাতে ব্রাহ্মণ্য যুগের জ্ঞান, ক্ষত্রিয়ের সভ্যতা, বৈশ্যের সম্প্রসারণ শক্তি এবং শূদ্রের সাম্যের আদর্শ মিলিত হয়েছে।" আমার বান্ধবীটির মতে স্বামীজির সেই স্বপ্নের দেশে কিনা আজ 'ঘরে ঘরে দামিনীর বাস'। ভাল করে ভেবে দেখলে ওর কথাটা একদমই অমূলক নয়। দেশে এমন মেয়ে খুব কমই আছে যারা কখনই ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানি বা ছেলেদের অভব্য আচরণের শিকার হয় নি, অন্তত নগ্ন চোখের পোশাক ভেদকরা নোংরা চাউনির চাটনি তো হতেই হয়েছে সবাইকে। আমরা স্বামীজির সেই স্বপ্নের দেশের অধিবাসী হয়েও খবরের কাগজে ধর্ষণের খবর দেখে ব্যথিত হওয়ার পরিবর্তে পুলকিত হই। স্বামীজির সেই স্বপ্নের দেশেই শিক্ষায় প্রথমস্থানাধিকারী রাজ্য কেরলে ১৩ বছরের মেয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে চাইছে না। কাঁদছে। কেন কাঁদছে? বাড়িতে দুবছর হল প্রতি দিন তাকে ধর্ষণ করছে তার বাবা, দাদা আর দুই কাকা। স্বামীজির সেই স্বপ্নের দেশে শাসক গোষ্ঠীর পোষ্য একপাল দস্যু কে যে-নারী ধর্ষণ করতে বাধা দিচ্ছে তার যৌনাঙ্গে লাঠির মাথা সোজা ভরে দেওয়া হচ্ছে; শুধু তাই নয় যন্ত্রণায় সে যখন দয়া চায়, গালাগালি করে তার সামনে তার কোলের শিশুটিকে দু’পা ধরে দুই দিকে টেনে সোজাসুজি ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। স্বামীজির সেই স্বপ্নের দেশেই ধর্ষণের পর ধর্ষিতার অভিযোগ লিখতে ঢিলেমি করে পুলিশ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলে সাজানো ঘটনা, রাজনৈতিক নেত্রী ধর্ষিতাকে যৌনকর্মী বলে উল্লেখ করে বলেন, “ওটা ধর্ষণের ঘটনাই নয়। ওই মহিলা আর তাঁর খদ্দেরদের মধ্যে গোলমাল।” আচ্ছা যৌনকর্মীকেও কি ধর্ষণ করা যায়? যৌনকর্মী ধর্ষিতা হলে কি তাঁর বিচার চাওয়ার অধিকার নেই!? স্বামীজির সেই স্বপ্নের দেশেই ধর্ষণের পর রাজনৈতিক নেতার মন্তব্য "অত রাতে ওই মহিলা ওখানে কি করছিল? সে তো ধর্ষিতা হতেই গিয়েছিল ওখানে।" ওহ দেশবন্ধু, দেশের সেবক, রাজনীতিবিদ একবার বলবেন কি ঠিক রাত কটার পর কোন মহিলা ঘর থেকে বের হলে তাকে ধর্ষণ করার অধিকার পাওয়া যায় বা তাকে ধর্ষণ করা টা স্বাভাবিক ঘটনার মধ্যে পরে?! স্বামীজির সেই স্বপ্নের দেশের রাজধানী দিল্লীতে এক মেয়েকে এক পাল পুরুষ বীভৎস ভাবে ধর্ষণ করেছে; শুধু গণধর্ষণ নয়, আরও ভয়ংকর কিছু, পুরুষাঙ্গ দিয়েই আঘাত করে শান্ত হয়নি তারা, লোহার রড যৌনাঙ্গে ঢুকিয়ে জরায়ু ফুটো করে পেটের নাড়ি ভুঁড়ি বের করে নিয়ে এসেছে। যৌনাঙ্গে যখন পেটের নাড়ি, তখনও তাদের ধর্ষণ বন্ধ হয়নি। ধর্ষণুল্লাশ শেষ হলে প্রায়-মৃত মেয়েকে চলন্ত বাস থেকে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে। সেই মেয়েটি মারা যাওয়ার পর দেশের ৭০% লোক বলে, পুরুষাঙ্গ কেটে ফ্যালো। ২২% লোক বলে, মৃত্যুদণ্ড দাও। ৮% লোক ইনিয়েবিনিয়ে নানা কথা বলে, what about teh menz?, পুরুষদেরও তো মেয়েরা ধর্ষণ করে, তার বেলা?, মেয়েটা নিশ্চয়ই পুরুষদের প্রোভোক করার জন্য গায়ে কিছু পরেছিল, বা কিছু মেখেছিল।
আপসহীন লেখক তসলিমা নাসরিন তার বাংলা ব্লগে ২০১২-র ২৯ শে ডিসেম্বর একটা প্রবন্ধ লেখেন “নাবালিকা ধর্ষণ” এই শিরনামে (http://muktobhabna.blogspot.in/2012/12/blog-post_870.html)
আর সেই লেখাটাই পরদিনের
আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়-তে ছাপা হয় “ল্যাজে পা” এই শিরনামে (http://www.anandabazar.com/archive/1121230/30rabipro3.html)। সেখানে তিনি বলেন "আমাদের কাছে আসলে ধর্ষণের সমাধান দুটো, হয় মৃত্যুদণ্ড, নয় পুরুষাঙ্গ-কর্তন। এ দুটো শাস্তি ধর্ষকদের দিলেই নাকি ধর্ষণের ইতি ঘটে। ইতি তো ঘটেইনি, বরং আকাশ ছুঁয়েছে। ধনঞ্জয়ের ফাঁসি হওয়ার পর পর ধর্ষণ বেড়ে গিয়েছিল, মনে নেই? দেশকে ধর্ষণমুক্ত করতে গেলে সরকারকে প্রচুর কাজ করতে হয়। প্রচুর পরিশ্রম। তার চেয়ে ধর্ষককে ফাঁসি দেওয়ার মতো সহজ কাজ আর কিছু নেই। জনগণও খুশি হয়। তখনকার মতো সব সমস্যাকে চমৎকার ধামাচাপা দেওয়া যায়। সরকার এ ভাবেই মানুষকে বোকা বানায়। মানুষ বুদ্ধিমান হয়ে গেলে বেজায় মুশকিল! তখন যে কাজগুলো করলে সমাজের সত্যিকার ভাল হয়, সে কাজগুলোর দাবি সরকারের কাছে করে বসবে বুদ্ধিমান মানুষেরা।" কবি জয় গোস্বামীও যে মৃত্যুদণ্ডে ধর্ষণের সমাধান দেখছেন না তার এক স্বচ্ছ চিত্র ফুটে উঠেছে তার 'কে বেশি কে কম' কবিতায় (http://banglalibrary.evergreenbangla.com/joygoswami/12)। জাভেদ-বৃন্দাদেরও যুক্তি, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডকে অনিবার্য মনে নিলে পুরুষতন্ত্রের চিরকেলে ধারণাটিকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যে দেশে বেশির ভাগ ধর্ষণই চেনা-জানার বৃত্তে, ক’জনকে ফাঁসিতে চড়ানো হবে?
তাহলে ধর্ষণ বন্ধ হবে কবে, অথবা কি করলে ধর্ষণ বন্ধ হবে? এই প্রশ্নটির সবচেয়ে ভাল উত্তর, আমরা যেদিন ধর্ষণ করা বন্ধ করব সেদিনই বন্ধ হবে ধর্ষণ; যদি আমরা আজ বন্ধ করি তবে আজ, যদি কাল করি তবে কাল, যদি এক মাস পরে করি তবে এক মাস পর আর যদি আমরা ধর্ষণ করা বন্ধ না করি তাহলে কোন দেশ, কোন রাষ্ট্র, কোন আইন, কোন শাস্তি, পুরুষাঙ্গ কর্তন বা মৃত্যুদণ্ড কোন কিছুই পারবে না বন্ধ করতে। তখন মৃত্যুর পর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলতে থাকবে এই পৈশাচিক পাপ। তাই যেদিন আমরা আত্মস্থ করতে পারব এই কথা গুলকে
"হে বীর, সাহস অবলম্বন কর; সদর্পে বল আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই; বল মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই; তুমিও কটিমাত্র-বস্ত্রাবৃত হইয়া সদর্পে ডাকিয়া বল ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারাণসী; বল ভাই ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ; আর বল দিনরাত, হে গৌরীনাথ, হে জগদম্বে, আমায় মনুষ্যত্ব দাও; মা, আমার দুর্বলতা কাপুরুষতা দূর কর, আমায় মানুষ কর।" সেদিন আমরা হব মনুষ্যত্ব সম্পন্ন মানুষ, আর যেদিন আমরা মানুষ হব, সেদিন আমাদের বিবেক বাধা দেবে ধর্ষণ করতে, সে দিনই বন্ধ হবে ধর্ষণ, গড়ে উঠবে নতুন ভারত, স্বামীজির স্বপ্নের ভারত।
চারিদিকে এখন অসুর শক্তির জয়জয়াকার, আত্মভ্রষ্ট যুবসমাজ পৈশাচিক আনন্দে বিভোর, লক্ষ্যশূণ্য অগণন যুবক সঙ্কটের আবর্তে বিপন্ন, বিমূঢ়, বিভ্রান্ত। এইসব যুবকের কাছে জীবন, আদর্শ, মানবসেবা মনে হয় অর্থহীন, অপ্রয়োজন। এ অদ্ভুত আঁধার চলিষ্ণু জাতির কাছে কখনই কাম্য হতে পারে না। কারণ যেকোনো জাতির কাছে তার যুবসমাজ হল তার সম্পদ। আজকের যুবসমাজের সম্যক ধারনা নেই দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে, নিজেদের অতীত ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি সম্পর্কে।
যেটা স্বামীজি সম্পূর্ণরূপে অর্জন করেছিলেন আসমুদ্রহিমাচল পদব্রজে ভ্রমণের সময়। যে কারণেই তিনি ভগ্নী নিবেদিতাকে বলতে পেরেছিলেন "আমিই ভারতবর্ষ"। তাই স্বামী বিবেকানান্দাকে জানলেই ভারতবর্ষ কে জানা হয়, জানা হয় দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য কে। বর্তমানে আমরা যে দুঃসহ ও জটিল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে চলেছি তাতে অকপট যাপন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে, সত্য অবলম্বনও খুব কঠিন হয়ে পড়েছে, ত্যাগব্রত নেহাতই কথার কথায় রূপান্তরিত হয়েছে। তাই সমাজের এই দুর্বিষহ অচল অবস্থা থেকে রেহাই পেতে গেলে আমাদের শপথ নিতে হবে তার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার যে মানুষটি তার সারাটা জীবন দিয়ে নতুন ভারত গড়ার স্বপ্ন দেখে গেলেন আর তা বাস্তবায়িত করার পথ বাতলে গেলেন। উপলব্ধি করতে শিখতে হবে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে, সুস্থ ব্যবহার করতে শিখতে হবে আমাদের ভিতরের প্রজ্ঞা, শক্তি ও তেজ কে আর আত্মস্থ করতে শিখতে হবে স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শকে।
৩০-০১-২০১৩